শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী শ্রীসারদা দেবীর জীবন আপাতদৃষ্টিতে অতিসাধারণ। জাগতিক ও পার্থিব যা কিছু সেসবের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু এক নীরব জীবনযাপনের গহন-গভীরে তিনি নিজেকে পারমার্থিক সত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অথচ বাইরে তার প্রকাশ নেই, থাকলেও যৎসামান্য। প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডে তাঁর অনুরাগ অপরিসীম, কিন্তু কোথাও আসক্তি নেই, বন্ধনও নেই। এক আদর্শ জীবনের মানবপ্রতিমা তিনি। নানা ভাবে, নানা রূপে তাঁর জীবনকে ব্যাখ্যা করা চলে। তাঁর এই অনন্ত প্রকাশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রকাশ তাঁর মাতৃভাব। তিনি নিজে বলতেন, ‘বাবা, জান তো ঠাকুরের জগতের প্রত্যেকের উপর মাতৃভাব ছিল? সেই মাতৃভাব জগতে বিকাশের জন্য আমাকে এবার রেখে গেছেন।’ এই মাতৃভাবের অন্তহীন আশ্রয়ে এসে মানুষ তাঁকে ‘মা’ কিংবা ‘শ্রীমা’ বলে ডাকতে দেরি করেনি। তবু তাঁর চিরন্তনী সর্বপ্লাবী মাতৃসত্তা সম্পর্কে সন্তানের কিছুমাত্র দ্বিধা বা সংশয়ের নিরসন শ্রীমা নিজেই করেছেন। জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমি সত্যিকারের মা, গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়, সত্য জননী।’ আশুতোষ মিত্রের লেখা ‘শ্রীমা’ গ্রন্থটিতে সারদাদেবীর সেই জননীরূপটি নানা বর্ণে, নানা ভাষ্যে, নানা বাণীবিন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম পার্ষদ ও ত্যাগীসন্তান এবং ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা আশুতোষ মিত্র মাত্র আঠারো বছর বয়সে শ্রীমায়ের পূতসান্নিধ্যে আসার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেন। এরপর থেকে সুদীর্ঘ তেরো বছর তিনি শ্রীমায়ের সেবকই শুধু ছিলেন না, মায়ের প্রাত্যহিক পুণ্য জীবনচর্যার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছিলেন। শ্রীমা সন্তান আশুতোষকে আদর করে বলতেন, ‘আমার কার্তিক’। শুধু শ্রীমা-ই নন, স্বামী বিবেকানন্দসহ শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যান্য ত্যাগীসন্তানদেরও সান্নিধ্য তিনি লাভ করেছিলেন। নিজের অগ্রজ এবং অন্যদের প্রভাবে আশুতোষ সন্ন্যাসজীবন বরণ করেছিলেন অচিরেই। কিন্তু কোনও গুরুতর কারণে শ্রীমায়ের জীবদ্দশাতেই রামকৃষ্ণ মঠের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এই বিপর্যয় সত্ত্বেও শ্রীমায়ের দিব্য জীবনের যে-সৌরভ এবং যে-অপার আশীর্বাদ আশুতোষ মিত্রকে ঘিরেছিল, তা আজীবন তিনি সযত্নে রক্ষা করেছেন, সন্তানের সঙ্গে মায়ের বন্ধন ছিন্ন হয়নি। শ্রীমাকে যেভাবে তিনি তেরো বছর ধরে পেয়েছিলেন, একান্তভাবে দেখেছিলেন, তাকে প্রকাশ করার একটা আকুতি তাঁর মধ্যে ছিল। তাঁর লেখা ‘শ্রীমা’ গ্রন্থখানি তারই ফলশ্রুতি। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে, অনুপুঙ্খ বর্ণনায় এখানে তিনি শ্রীমায়ের স্মৃতিকথা এঁকেছেন। বইটি জীবনীগ্রন্থ নয়, বরং শ্রীমায়ের জীবনভাষ্য। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হিসেবে আশুতোষের এই সুখপাঠ্য গ্রন্থটি একদা অনুরাগী ও ভক্তমণ্ডলীর কাছে বিশেষ সমাদর লাভ করেছিল। কিন্তু কালক্রমে বইটি দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়। এই সময়ে শ্রীসারদাচর্চা এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে তাঁর জীবন ও বাণী সম্পর্কে আগ্রহ ক্রমবর্ধমান। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, শ্রীমায়ের অনন্য জীবন প্রতিমুহূর্তে চলার পথ দেখাতে সমর্থ। মানুষের সেই বিশ্বাসকে মনে রেখে আশুতোষ মিত্রের ‘শ্রীমা’ গ্রন্থটি পুনরায় প্রকাশিত হল।
[Source: Patra Bharati]
Reviews
There are no reviews yet.