শহরের নাম ঢাকা। ‘ত্রিশের দশকের ঊষালগ্নে আমার বয়স দুই কিংবা তিন।’ শৈশব এগিয়ে চলে সেই শহরে, গোল্লাছুট আর কানামাছির অমল শৈশব। তারপর একদিন আর্মেনিটোলা স্কুল। শৈশব থেকে কৈশোর। স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ অধ্যায়। দাঙ্গা। মন্বন্তর। দেশভাগ। ওদিকে ‘আমরা স্কুলের উঁচুক্লাসে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত বিপ্লবের কথা শুনতে শুরু করেছি।’ এইভাবেই পাতায় পাতায় পর্ব থেকে পর্বান্তরে উন্মোচিত হয় এক বহুমাত্রিক মানুষের বর্ণময় জীবনের কাহিনি। ‘আপিলা-চাপিলা’ এই মানুষটির এলোমেলো ইতস্তত বিচ্ছিন্ন জীবনচর্যার উপাখ্যান। নিজেকে ঘোর অপছন্দ করেন, নিজের গোটা জীবনটাকেও, কিন্তু সেই কবুলতি থেকে নিজেকে তিনি বঞ্চিত করেননি। সেই শৈশবে শুনেছিলেন একটি গ্রাম্য ছড়া ‘আপিলা-চাপিলা ঘন-ঘন কাশি, রামের হুঁকো শ্যামের বাঁশি…।’ সেই ছড়াটিই অবচেতনার স্তর থেকে বেরিয়ে এসে লেখকের চেতনায়, সত্তায় যেন মিশে গেছে। ‘এখন মনে হয় গোটা জীবনটাই ছড়াটির মতো। যতগুলি পর্ব পেরিয়ে এসেছি, বেশির ভাগই ঝাপসা কুয়াশায় আবৃত, কোনও-কোনও মানুষজন-ঘটনার কথা মনে পড়ে। অনেক কিছু পড়ে না।’ এই স্মৃতিকথা ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মকথন নয়, আবার নিছক একটি বিশেষকালের বিশ্লেষণ-সম্পৃক্ত রাজনৈতিক বৃত্তান্তও নয়। দেশ, কাল, সমাজ, একাকী ও যূথবদ্ধ মানুষ, বিত্তশালী-মধ্যবিত্ত-বিত্তহীন মানুষ, সমসময়ের কাব্য-সাহিত্য-রাজনীতি-অর্থনীতি ইতিহাস— সব মিলিয়ে এক বিরাট প্রেক্ষাপটে বিধৃত আত্মকাহিনি। আবার আত্মকথা হয়েও ‘আপিলা-চাপিলা’ বহু মানুষের জীবনকথা। এই মানুষ পথিক মানুষ, পদাতিক মানুষ, কবিতা থেকে মিছিলের অসংখ্য সাধারণ মানুষ। যাঁরা সহস্র প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যুগ যুগ ধরে ইতিহাস লিখে চলেছেন। আত্মকথার সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে ‘আপিলা-চাপিলা’ এক ব্যাপ্ত সময়ের কণ্ঠস্বর। লেখকের মানসিকতা আপাতবিচারে বিষণ্ণ নাস্তিকতায় সমাচ্ছন্ন, তা হলেও হয়তো এই বৃত্তান্তের মধ্যেই একটি বিশেষ জীবনদর্শন নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছে। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের সময় ‘আপিলা-চাপিলা’ পাঠকমহলে তুমুল আলোড়ন তুলেছে যেমন, তেমনই আবার সত্যভাষণের উজ্জ্বল স্বাতন্ত্রে এবং হারানো দিন আর হারানো মানবজনের স্মৃতি উসকে দেওয়ার মরমি মানবিকতায় বহুজনের কাছে সমাদৃত হয়েছে। সেই শাণিত তর্কমুখর, অকপট আত্মকথন এবার গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল।
[Source: Ananda Publishers]
Reviews
There are no reviews yet.