রসিকজন বলেন, ‘মানভূমি, না গানভূমি।’ মানভূম-পুরুলিয়ার যে-বিচিত্র জীবনের কথকতা এই উপন্যাস, সেই জীবনধারাও যেন আঞ্চলিক ভূ-প্রকৃতির আদলেই গড়া, আশ্চর্য কোমল এবং অদ্ভুত কঠিন। রুক্ষ, পাথুরে একফসলী মাটি আজও আকাশনির্ভর, মানুষগুলি কায়ক্লিষ্ট ও হতদরিদ্র, তবু তারা জীবনরসের অফুরন্ত প্রবাহে ধনী। যেন নীরস পাথরে ফুটে-ওঠা একগুচ্ছ সুগন্ধী ফুল, যারা ‘চললেই নাচ আর বললেই গান’। সুর ও ছন্দ তাদের শিরায়-ধমনীতে, নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে, এবং জীবন ও মৃত্যু—এই দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী প্রবাহের কেন্দ্রে। এই সুরের নামই ঝুমুরগান—স্থানীয় কবিয়ালদের সহজাত প্রতিভার সৃষ্টি, এই ছন্দ হল, ঝুমুরগানেরই নৃত্য-রূপায়ণ। এ-ঝুমুর শুধুই জড়িয়ে নেই রাধাকৃষ্ণের অনুষঙ্গে, এ-ঝুমুরের অন্তরতম রূপটিতে প্রতিবিম্বিত মানভূমের মানুষের জীবনেরই নির্মম চিত্রকথা, যা মিশে গেছে রসিক-নাচনীর জীবনযাপনে ও জীবনভিত্তিক গানের নিবেদনে। সেই রসিক-নাচনী জীবনেরই এক পরম কৌতুহলকর ও বিচিত্র উপাখ্যান এই উপন্যাস। পরিশ্রমী ও অন্তরঙ্গ এ-উপন্যাসের নায়ক রসিক, নায়িকা নাচনী এবং তাদের মিলন-বিরহ-দুঃখ-আনন্দময় জীবনের অনন্য অবলম্বন নৃত্য-গীত, সুর-ছন্দ। রসিক শব্দটির উৎস রসসাধনা। জীবনরসে জরজর ডুবতে পারে যে-মানুষ, নিজেকে জানতে সুর-তালের স্রোতে যার অবিরাম ভেসে-চলা, সেই তো রসিক। নাচনী নাচেরও দুটি ঘরানা। একটি সরু তালের, অন্যটি মোটা। রসিক-নাচনী হলেন তথাকথিত বিবাহ-বন্ধনহীন দুই নরনারী। শিল্পসাধনের সহচর সহচরী। ‘রসিক’ এই রসিক-নাচনীর সুরতালস্পন্দিত পরস্পরনির্ভর জীবনেরই এক গীতিকাব্য, অথবা একখানি অনবদ্য ঝুমুরগান। একদিকে বিজলিবালা ও পাণ্ডবকুমার, সমান্তরালভাবে দুলালী ও তরণীসেনের উপাখ্যান। একটিতে সিদ্ধিময় সাধনা, অন্যটিতে অচরিতার্থতার বেদনা। দুটি অসম কাহিনীকে এক আধারে মিশিয়ে দিয়ে উপন্যাসের প্রচলিত আঙ্গিকে অভিনবত্ব আনার জন্য নয়, বাংলা সাহিত্যে এমন একটি নতুন বিষয় নিয়ে প্রথম লেখার জন্যও নয়, গভীর জীবনবোধ থেকে উৎসারিত এক দৃষ্টি দিয়ে অবহেলিত এক সমাজকে দেখা এবং নির্মোহ ভঙ্গিতে তাদের জীবনযাত্রার হুবহু এক চলচ্চিত্র-সৃষ্টির প্রয়াসের জন্যই এ-সব ছাপিয়ে এ-উপন্যাস শেষাবধি পৌঁছে গেছে ক্লাসিকের পর্যায়ে।
[Source: Ananda Publishers]
Reviews
There are no reviews yet.