সম্মুখে থাকুন বসি পথ রুধি রবীন্দ্রঠাকুর/ আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষ্ণ আলো/ যুগ-সূর্য ম্লান তার কাছে।’ -এই স্পর্ধিত উক্তি যে-কবির, সেই অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তই আরেকটি কবিতায় যখন লেখেন, ‘আমি তো ছিলাম ঘুমে/ তুমি মোর শির চুমে/ গুঞ্জরিলে কী উদাত্ত মহামন্ত্র মোর কানেকানে’, তখন, সাধারণভাবে, একটু-যে বিস্ময় জাগে, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যাঁর জানা, সেই পাঠকের কাছে এ-উক্তি মোটেও পরস্পরবিরোধী মনে হবে না। কল্লোল-যুগের তরুণ লেখকদের কাছে রবীন্দ্র-বিরোধিতা ছিল অপরিহার্য এক সাহিত্য-আন্দোলনেরই নামান্তর। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এই প্রকাশ্য-বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হয়েছিল তাঁদের। কবিয়ানা মানেই ‘রবিয়ানা’, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তিনিই সব-কিছুর চরম পরিপূর্ণতা, তাঁর পরে আর পথ নেই, সংকেত নেই—এ-কথা মেনে নিলে সাহিত্য যে থেমে যায়, তরুণ লেখকদের আত্মপ্রকাশের পথ যে যায় রুদ্ধ হয়ে, এই ভেবেই কল্লোলগোষ্ঠীর তরুণ লেখকেরা এভাবে রবীন্দ্র-বিরোধিতায় উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে হেয় করার উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল না, বরং মনে-মনে এঁরা প্রত্যেকেই রবীন্দ্রনাথকে বসিয়ে রেখেছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে, এর প্রমাণ বারবার তাঁদের রচনায় ফুটে উঠেছে। শুধু কল্লোল-যুগেই নয়, পরবর্তীকালের সাহিত্যেও বারবার প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে রবীন্দ্র-বিরোধিতার এই স্বাস্থ্যকর সাহিত্য-আন্দোলন। একইসঙ্গে, বারবারই শোনা গেছে ‘প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা’ ছড়ানোর স্বীকারোক্তি। তাঁকে ঘিরে স্তুতি-রচনা, প্রশস্তি-প্রসারণ। এখানেই রবীন্দ্রনাথের জয়, এখানেই তাঁর সার্বভৌমত্ব। কালজয়ী তাঁকে অস্বীকার না করে উপায় নেই, তাঁকে অস্বীকার করাও অসম্ভব। সমকালে যেমন, তাঁর জন্মের এত বছর পরেও তেমনি, তাঁকে ঘিরে কৌতুহলে একটুও ভাঁটা পড়েনি, চর্চা-উচ্ছ্বাসের জোয়ার মুহূর্তের জন্যও হয়নি স্তিমিত। সেই কবে কলকাতার এক মেলাপ্রাঙ্গণে কিশোর রবীন্দ্রনাথকে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে দেখে অভিভূত নবীনচন্দ্র সেনের মনে হয়েছিল বৃক্ষতলে স্বর্ণমূর্তির স্থাপনা হয়েছে, সেই কবে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কণ্ঠে অর্পণ করেছিলেন মালা, আজও তার রেশ স্তব্ধ হয়নি। আজও তরুণ লেখকগোষ্ঠী তাঁর জন্মদিনের মালা সাজান পত্র-পত্রিকার ফুলে, আজও তাঁর নামে উৎসর্গ করেন একটি তাজা রচনার অর্ঘ্য। রবীন্দ্রনাথের এক শো পঁচিশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত হল এমনই এক শ্রদ্ধার্ঘ্য সংকলন, ‘রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত’। তাঁর সমকাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময়সীমার মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে যেসব স্মরণীয় কবিতা রচিত হয়েছে, তারই এক সুনির্বাচিত ও সুপ্রতিনিধিত্বমূলক সংগ্রহ এই সংকলন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা দিয়ে শুরু, শেষ, সত্তরের কবিতে। এক শো পঁচিশ বছরের জন্মজয়ন্তী মনে রেখে, এক শো পঁচিশ জন কবির কবিতা এতে গৃহীত হয়েছে। তবে নিছক স্তুতি-বন্দনাই গ্রহণ করা হয়নি। কেননা, অনবরত প্রশস্তিতে কিছুটা একঘেয়েমি আসতে বাধ্য। কবিতাগুলিতে নানা রকম বৈচিত্র্য তো আছেই, উপরন্তু, কোন কবি কীভাবে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে, তারও আকর্ষণীয় পরিচয় ফুটে উঠেছে। নানা রবীন্দ্রনাথের এক অনুপম মালা এই সংকলন।
[Source: Ananda Publishers]
Reviews
There are no reviews yet.