উনিশ শতকের শেষ কুড়ি বছরে বাঙালির মননলোকে যে-দুরন্ত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল, তা প্রায় বিপ্লবের সমার্থক। নবজাগরণ বা রেনেসাঁর সূচনা অবশ্য তারও আগে। কিন্তু এই জাগরণের একটা সুস্পষ্ট চেহারা ও সমকালীন জীবনের প্রেক্ষাপটে এর পরিণতি লক্ষ করা গেল এই সময়পর্বে। অন্যান্য অভাবনীয় পরিবর্তনের মধ্যে সমসময়ের প্রেক্ষাপটে যেটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য তা হল, কোনও কিছু লেখার অধিকার বা কলমের অধিকার, পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীরও করায়ত্ত হল। এই অধিকারবোধের সূচনা হয়তো আরও একটু আগে, কিন্তু এর প্রতিষ্ঠা এই সময়কালে। বাড়ির অন্দরে, পুকুরঘাটে, যাতায়াতের গলিপথের গল্পকে বাঙালি নারী কলমের মাধ্যমে প্রথমে লিখলেন, তারপর তুলে দিলেন পত্রিকায়। সেইসব গল্প অচিরে প্রকাশিত হল, যা ছিল মহিলামহলের ঘরোয়া গল্প, তা রূপান্তরে হল ‘সাহিত্য’। কলমের অধিকার আয়ত্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে নারীর কাছে উন্মোচিত হল জীবনের নতুন নতুন দিক। সেই সন্ধিলগ্ন থেকে নতুন দরজা খুলে বাইরের জগৎকে সে বুঝতে শিখল। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি গদ্যনির্ভর সাহিত্যের নানা দিকে নারীর চিন্তা-চেতনার বীজ চারিয়ে গেল। বিশেষত গল্প রচনার নবীন অঙ্গনে তার স্বচ্ছন্দ পদক্ষেপ এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। তখন স্বর্ণকুমারী দেবী ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন। বলতে গেলে তাঁর সম্পাদনা-পর্বে সৃষ্টিশীল সাহিত্যে মহিলা লেখকরা গল্পকার রূপে শুধু আত্মপ্রকাশই করলেন না, তাঁদের জয়যাত্রাও শুরু হল। সেই অভিযাত্রা আজও অব্যাহত। এই সংকলনে যে-সময়কে ধরা হয়েছে, সে সময়ে দেশ পরাধীন। তখন মহিলাদের শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রটি এত বিস্তৃত হয়ে উঠেনি। বরং স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধতা প্রবল হয়েছে। সামান্য কিছু আলোকপ্রাপ্ত পরিবার বাদে মেয়েদের শিক্ষাদান সমাজ বরদাস্ত করেনি, উপরন্তু তর্ক তুলেছে, পঠনপাঠন বলপ্রয়োগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবু গত ১৩০০ শতকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নারীর লেখা গল্পের সংখ্যানুপাত ১৪০০ শতককে লজ্জা দেবে। এই সংকলনে গৃহীত সব গল্পই কোনও-না-কোনও পত্রিকায় প্রকাশিত। বহু পত্র-পত্রিকা অনুসন্ধান করে চূড়ান্ত ভাবে এগুলি নির্বাচিত হয়েছে। সংকলনভুক্ত গল্পগুলির বিষয়বস্তু কখনও চিরন্তন নারী-পুরুষের সম্পর্ক, কখনও তার ঊর্ধ্বে সামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক জীবনের নানা জটিলতার গহনতল। কিংবা ব্যক্তিনারীর মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংকট। সব গল্পই অসাধারণ এমন দাবি সঙ্গত কারণেই করা যায় না। কিন্তু প্রতিটি গল্পই নারীর সৃষ্টিধর্মী নিদর্শন হিসেবে অসাধারণ। অসামান্যের বিচার এখানে গৌণ। একই সঙ্গে একশোজন লেখিকার মানসিক পরিমণ্ডল, তাঁদের জীবনদর্শন, সর্বোপরি কেমন করে তাঁরা ভাবতেন, বুঝতেন এবং দেখতেন জীবন ও জগৎকে— তার হদিশ এখানে পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে তাঁদের অনুভব ও সৃজন প্রতিভার নানা দিকচিহ্ন। এই প্রাপ্তিও এ যুগের পরিপ্রেক্ষিতে বড় কম নয়।
[Source: Ananda Publishers]
Reviews
There are no reviews yet.